৩য় অধ্যায় : তৎকালীন প্রচলিত ধর্মীয় বিশ্বাস ও সামাজিক কুসংস্কার

কুরাইশদের অংশীবাদ ও পৌত্তলিকতা

মক্কায় অবস্থিত কা’বা গৃহটি ছিল পৃথিবীর আদিতম উপাসনালয়। এক ও অদ্বিতীয় আল্লাহর উপাসনার জন্যই এ গৃহটি নির্মিত হয়েছিল। ফেরেশতাদের উপাসনালয় ”বায়তুল মা’মুরের” আদলে এটি প্রথম নির্মাণ করেছিলেন হযরত আদম (আঃ)। হযরত নূহের সময়ে আল্লাহর গযব হিসেবে এক মহা প্লাবন নাযিল হয়। তখন এই উপাসনালয়টি ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছিল। এরপর মহান আল্লাহর নির্দেশে হযরত ইব্রাহীম (আঃ) ও তদীয় পুত্র হযরত ইসমাঈল (আঃ) এটির পুনর্নির্মাণ করেন এবং বাৎসরিক হজ্জ্ব, ওমরাহ ও কুরবানীর প্রচলন করেন। তখন থেকেই মক্কার এ কা’বা গৃহটি মানবজাতির উপাসনালয় ও আল্লাহর একত্ববাদের প্রচার ও প্রসারের কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে পরিগণিত হয়।

কিন্তু মক্কাবাসী পরবর্তী প্রজন্মসমূহ শয়তানের কুপ্ররোচনায় পথভ্রষ্ট হয়ে পড়ে এবং হযরত ইব্রাহীম (আঃ) ও হযরত ইসমাঈল (আঃ) এর একত্ববাদের বিশ্বাস থেকে তাদের বিচ্যুতি ঘটে। এক ও অদ্বিতীয় আল্লাহর পরিবর্তে তারা কাল্পনিক বিভিন্ন দেব–দেবীর পূজা–অর্চনা ও উপাসনায় লিপ্ত হয়ে পড়ে। পৌত্তলিকতায় আকৃষ্ট হয়ে তারা কা’বা গৃহে ৩৬০টি মূর্তি স্থাপন করে। হোবল নামীয় এক মানবাকৃতির প্রতিমা ছিল সেগুলোর মধ্যে সব চেয়ে বড়। এছাড়া লাত, মানাত ও ওজ্জা দেবীর মূর্তিগুলো ছিল উল্লেখযোগ্য। এগুলোকে তারা আল্লাহর কন্যা হিসেবে সাব্যস্ত করেছিল। প্রতিমা পূজারীরা মনে করত এ সব দেব–দেবীর পূজা–অর্চনাই তাদেরকে মহান আল্লাহর করুণা লাভে সাহয্য করবে। তাই তারা সর্বশক্তিমান আল্লাহর উপাসনা বাদ দিয়ে নিজ হাতে তৈরী কল্পিত দেব–দেবীর মূর্তির উপাসনাকেই পরম ধ্যান ও জ্ঞান মনে করত। সৃষ্টির সেরা জীব হওয়া সত্ত্বেও মানুষ পৌত্তলিকতার দ্বারা নিজেদের উচ্চ মর্যাদাকে ভূলুণ্ঠিত করেছে যা ছিল মানবতার জন্য একটি হীনতম কাজ।

পৌত্তলিকতায় বিশ্বাসী মুশরিকগণ শিরক, কুফর ও মূর্তিপূজা  ছাড়াও তারা বিভিন্ন ধরনের কুসংস্কারে লিপ্ত হয়ে পড়ে। আল্লাহর উপর তাদের বিশ্বাসের ধরন ছিল ভিন্ন। তারা মনে করত আল্লাহ্ সবার উপরে বিরাজ করলেও পার্থিব বিভিন্ন বিষয়ে দেব–দেবীগণ তাঁর প্রতিনিধিত্ব করে এবং তিনি তাদের সুপারিশ গ্রহণ করেন। এ ছাড়া পরকালের হিসাব-নিকাশ ও প্রতিফল (বেহেশত-দোযখ) সম্পর্কে তাদের কোন বিশ্বাস ছিল না। তারা মনে করত, এ দুনিয়ার জীবনই একমাত্র জীবন। মৃত্যুর পর আর কোন জীবন নেই, নেই কোন জবাবদিহিতা। এসব ভ্রান্ত ও অলীক বিশ্বাস তাদেরকে নীতি–নৈতিকতাহীন বেপরোয়া জীবন যাপনে অভ্যস্ত করে তুলেছিল।

ইসলাম-পূর্ব যুগে মক্কার কুরাইশ সম্প্রদায়ের লোকেরা ছিল কঠোর প্রকৃতির। তারা দাম্ভিকতা প্রদর্শন, পারস্পরিক কলহ, অন্যায় ও অবিচার, পরস্ব অপহরণ, লুটতরাজ,ইত্যাদিতে লিপ্ত ছিল। অপরিমিত ভোগবিলাস, বেপরোয়া ও মদ্যপী জীবনাচারণে তারা ছিল সিদ্ধহস্ত। ‘জোর যার মুল্লুক তার’ – এ নীতিতে তা ছিল বিশ্বাসী। বংশ পরম্পরায় প্রতিশোধ ও প্রতিহিংসার ধারা তাদের মধ্যে অব্যাহত ছিল। পরকালীন অনন্ত জীবনে তাদের কোন বিশ্বাস ছিল না। তাই পরকালীন জবাবদিহির ভয় যেমন তাদের মধ্যে ছিল না এবং তেমনি জান্নাত–জাহন্নামের বিষয়েও তারা ছিল উদাসীন। তারা মনে করতো দেব–দেবীর আরাধনাই তাদের কৃত সকল পাপ থেকে রেহাই পাওয়ার উপায়।

সে যুগে নারী জাতি ছিল চরম অবহলো, নিগ্রহ ও অন্যায়ের শিকার । আরবদের মধ্যে কন্যা সন্তান সম্পর্কে কুপ্রথা চালু ছিল। তারা কন্যা সন্তানের জন্মকে অভিশাপ ও অপমানজনক মনে করত এবং মনঃকষ্টে ভুগতো। মনস্তাপজনিত কারণে তারা কন্যা সন্তানকে মাটিতে জীবন্ত প্রোথিত করে ফেলতো। এতীম শিশুদের প্রতি তারা ছিল দায়িত্বজ্ঞানহীন। তাদের পৈতৃক সহায়–সম্পদ আত্মসাৎ করতে তারা দ্বিধাবোধ করত না। আরববাসীরা ছিল নির্মম অত্যাচার, শোষণ, জুলুম ও নির্যাতনের এক মূর্ত প্রতিচ্ছবি।

পবিত্র কুরআনে তাদের এ ধরনের অলীক, অবান্তর ও শয়তানী ধ্যান-ধারণার কথা বর্ণিত হয়েছে:

إِن يَدْعُونَ مِن دُونِهِ إِلَّا إِنَاثًا وَإِن يَدْعُونَ إِلَّا شَيْطَانًا مَّرِيدًا ۝   لَّعَنَهُ اللَّهُ ۘ وَقَالَ لَأَتَّخِذَنَّ مِنْ عِبَادِكَ نَصِيبًا مَّفْرُوضًا ۝   وَلَأُضِلَّنَّهُمْ وَلَأُمَنِّيَنَّهُمْ وَلَآمُرَنَّهُمْ فَلَيُبَتِّكُنَّ آذَانَ الْأَنْعَامِ وَلَآمُرَنَّهُمْ فَلَيُغَيِّرُنَّ خَلْقَ اللَّهِ ۚ وَمَن يَتَّخِذِ الشَّيْطَانَ وَلِيًّا مِّن دُونِ اللَّهِ فَقَدْ خَسِرَ خُسْرَانًا مُّبِينًا  ۝  يَعِدُهُمْ وَيُمَنِّيهِمْ ۖ وَمَا يَعِدُهُمُ الشَّيْطَانُ إِلَّا غُرُورًا۝

”তারা আল্লাহকে পরিত্যাগ করে শুধু নারীর আরাধনা করে এবং শুধু অবাধ্য শয়তানের পূজা করে– যার প্রতি আল্লাহ অভিসম্পাত করেছেন। শয়তান বলল: আমি অবশ্যই তোমার বান্দাদের মধ্য থেকে নির্দিষ্ট অংশগ্রহণ করব। তাদেরকে পথভ্রষ্ট করব, তাদেরকে আশ্বাস দেব; তাদেরকে পশুদের কর্ণ ছেদন করতে বলব এবং তাদেরকে আল্লাহর সৃষ্ট আকৃতি পরিবর্তন করতে আদেশ দেব। যে কেউ আল্লাহকে ছেড়ে শয়তানকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করে, সে প্রকাশ্য ক্ষতিতে পতিত হয়। সে তাদেরকে প্রতিশ্রুতি দেয় এবং তাদেরকে আশ্বাস দেয়। শয়তান তাদেরকে যে প্রতিশ্রুতি দেয়, তা সব প্রতারণা বৈ নয়।” (৪:১১৭ – ১২০)

أَفَرَأَيْتُمُ اللَّاتَ وَالْعُزَّىٰ ۝   وَمَنَاةَ الثَّالِثَةَ الْأُخْرَىٰ ۝   أَلَكُمُ الذَّكَرُ وَلَهُ الْأُنثَىٰ  ۝  تِلْكَ إِذًا قِسْمَةٌ ضِيزَىٰ  ۝  إِنْ هِيَ إِلَّا أَسْمَاءٌ سَمَّيْتُمُوهَا أَنتُمْ وَآبَاؤُكُم مَّا أَنزَلَ اللَّهُ بِهَا مِن سُلْطَانٍ ۚ إِن يَتَّبِعُونَ إِلَّا الظَّنَّ وَمَا تَهْوَى الْأَنفُسُ ۖ وَلَقَدْ جَاءَهُم مِّن رَّبِّهِمُ الْهُدَىٰ۝

“তোমরা কি ভেবে দেখেছ লাত ও ওযযা (দেবীদ্বয়) সম্পর্কে। এবং তৃতীয় আরেকটি (দেবী) মানাত সম্পর্কে? পুত্র–সন্তান কি তোমাদের জন্যে এবং কন্যা–সন্তান আল্লাহর জন্য? এমতাবস্থায় এটা তো হবে খুবই অসংগত বন্টন। এগুলো কতগুলো নাম বৈ নয়, যা তোমরা এবং তোমাদের পূর্ব-পুরুষরা রেখেছ। এর সমর্থনে আল্লাহ কোন দলীল নাযিল করেননি। তারা অনুমান এবং প্রবৃত্তিরই অনুসরণ করে। অথচ তাদের কাছে তাদের পালনকর্তার পক্ষ থেকে পথ নির্দেশ এসেছে।” (৫৩:১৯ – ২৩)

قُلْ اَرَءَیْتُمْ مَّا تَدْعُوْنَ مِنْ دُوْنِ اللّٰهِ اَرُوْنِیْ مَاذَا خَلَقُوْا مِنَ الْاَرْضِ اَمْ لَهُمْ شِرْکٌ فِی السَّمٰوٰتِ ؕ اِیْتُوْنِیْ بِكِتٰبٍ مِّنْ قَبْلِ هٰذَاۤ اَوْ اَثٰرَۃٍ مِّنْ عِلْمٍ اِنْ کُنْتُمْ صٰدِقِیْنَ ۝ وَ مَنْ اَضَلُّ مِمَّنْ یَّدْعُوْا مِنْ دُوْنِ اللّٰهِ مَنْ لَّا یَسْتَجِیْبُ لَہٗۤ اِلٰی یَوْمِ الْقِیٰمَۃِ وَ هُمْ عَنْ دُعَآئِهِمْ غٰفِلُوْنَ ۝ وَ اِذَا حُشِرَ النَّاسُ كَانُوْا لَهُمْ اَعْدَآءً وَّ كَانُوْا بِعِبَادَتِهِمْ کٰفِرِیْنَ ۝

“বলুন, তোমরা আল্লাহ ব্যতীত যাদের পূজা কর, তাদের বিষয়ে ভেবে দেখেছ কি? দেখাও আমাকে তারা পৃথিবীতে কি সৃষ্টি করেছে? অথবা নভোমন্ডল সৃজনে তাদের কি কোন অংশ আছে? এর পূর্ববর্তী কোন কিতাব অথবা পরস্পরাগত কোন জ্ঞান আমার কাছে উপস্থিত কর, যদি তোমরা সত্যবাদী হও। যে ব্যক্তি আল্লাহর পরিবর্তে এমন বস্তুর পূজা করে, যে ক্বিয়ামত পর্যন্তও তার ডাকে সাড়া দেবে না, তার চেয়ে অধিক পথভ্রষ্ট আর কে? তারা তো তাদের পূজা সম্পর্কেও বেখবর। যখন মানুষকে হাশরে একত্রিত করা হবে, তখন তারা তাদের শত্রু হবে এবং তাদের ইবাদত অস্বীকার করবে।” (৪৬:৪ – ৬)

পৌত্তলিকতার অসারতা সম্পর্কে অবহিত করে পবিত্র কুরআনে আল্লাহ্ তাঁর নবীকে বলেন:

قُلْ أَنَدْعُو مِن دُونِ اللَّهِ مَا لَا يَنفَعُنَا وَلَا يَضُرُّنَا وَنُرَدُّ عَلَىٰ أَعْقَابِنَا بَعْدَ إِذْ هَدَانَا اللَّهُ كَالَّذِي اسْتَهْوَتْهُ الشَّيَاطِينُ فِي الْأَرْضِ حَيْرَانَ لَهُ أَصْحَابٌ يَدْعُونَهُ إِلَى الْهُدَى ائْتِنَا ۗ قُلْ إِنَّ هُدَى اللَّهِ هُوَ الْهُدَىٰ ۖ وَأُمِرْنَا لِنُسْلِمَ لِرَبِّ الْعَالَمِينَ

“(হে নবী) আপনি বলে দিন: আমরা কি আল্লাহ ব্যতীত এমন বস্তুকে আহ্বান করব, যে আমাদের উপকার করতে পারে না এবং ক্ষতিও করতে পারে না এবং আমরা কি পশ্চাৎপদে ফিরে যাব, এরপর যে, আল্লাহ আমাদেরকে পথ প্রদর্শন করেছেন? ঐ ব্যক্তির মত, যাকে শয়তানরা বনভূমিতে বিপথগামী করে দিয়েছে – সে উদভ্রান্ত হয়ে ঘোরাফেরা করছে। তার সহচররা তাকে পথের দিকে ডেকে বলছেঃ আস, আমাদের কাছে। আপনি বলে দিন: নিশ্চয় আল্লাহর পথই সুপথ। আমরা আদিষ্ট হয়েছি যাতে স্বীয় পালনকর্তা আজ্ঞাবহ হয়ে যাই।” (৬:৭১)

اِنَّ الَّذِیْنَ تَدْعُوْنَ مِنْ دُوْنِ اللّٰهِ عِبَادٌ اَمْثَالُکُمْ فَادْعُوْهُمْ فَلْیَسْتَجِیْبُوْا لَکُمْ اِنْ کُنْتُمْ صٰدِقِیْنَ ۝ اَلَهُمْ اَرْجُلٌ یَّمْشُوْنَ بِهَاۤ ۫ اَمْ لَهُمْ اَیْدٍ یَّبْطِشُوْنَ بِهَاۤ ۫ اَمْ لَهُمْ اَعْیُنٌ یُّبْصِرُوْنَ بِهَاۤ ۫ اَمْ لَهُمْ اٰذَانٌ یَّسْمَعُوْنَ بِهَا ط

“আল্লাহকে বাদ দিয়ে তোমরা যাদেরকে ডাক, তারা সবাই তোমাদের মতই বান্দা। অতএব, তোমরা যাদেরকে ডাক, তখন তাদের পক্ষেও তো তোমাদের সে ডাক কবুল করা উচিত যদি তোমরা সত্যবাদী হয়ে থাক? তাদের কি পা আছে, যদ্দ্বারা তারা চলাফেরা করে, কিংবা তাদের কি হাত আছে, যদ্বারা তারা ধরে। অথবা তাদের কি চোখ আছে যদ্বারা তারা দেখতে পায় কিংবা তাদের কি কান আছে যদ্বারা শোনতে পায়?…..” (৭:১৯৪ – ১৯৫)

আরবের তৎকালীন সামাজিক কুসংস্কার ও নারীদের প্রতি বিরাজমান কুপ্রথা সম্পর্কে কুরআনে বলা হয়েছে:

كَلَّا ۖ بَل لَّا تُكْرِمُونَ الْيَتِيمَ۝ وَلَا تَحَاضُّونَ عَلَىٰ طَعَامِ الْمِسْكِينِ۝ وَتَأْكُلُونَ التُّرَاثَ أَكْلًا لَّمًّا۝ وَتُحِبُّونَ الْمَالَ حُبًّا جَمًّا۝

“এটা অমূলক, বরং তোমরা এতীমকে সম্মান কর না। এবং মিসকীনকে অন্নদানে পরস্পরকে উৎসাহিত কর না। এবং তোমরা মৃতের ত্যাজ্য সম্পত্তি সম্পূর্ণরূপে কুক্ষিগত করে ফেল এবং তোমরা ধন–সম্পদকে প্রাণভরে ভালবাস।” (৮৯:১৭-২০)

وَ اِذَا بُشِّرَ اَحَدُهُمْ بِالْاُنْثٰی ظَلَّ وَجْهُہٗ مُسْوَدًّا وَّ هُوَ كَظِیْمٌ ۝ یَتَوَارٰی مِنَ الْقَوْمِ مِنْ سُوْٓءِ مَا بُشِّرَ بِہٖ ؕ اَیُمْسِکُہٗ عَلٰی هُوْنٍ اَمْ یَدُسُّہٗ فِی التُّرَابِ ؕ اَلَا سَآءَ مَا یَحْکُمُوْنَ ۝

“যখন তাদের কাউকে কন্যা সন্তানের সুসংবাদ দেয়া হয়, তখন তারা মুখ কাল হয়ে যায় এবং অসহ্য মনস্তাপে ক্লিষ্ট হতে থাকে। তাকে শুনানো সুসংবাদের দুঃখে সে লোকদের কাছ থেকে মুখ লুকিয়ে থাকে। সে ভাবে, অপমান সহ্য করে তাকে থাকতে দেবে, না তাকে মাটির নীচে পুতে ফেলবে। শুনে রাখ, তাদের ফয়সালা খুবই নিকৃষ্ট।” (১৬:৫৮ – ৫৯)

قَدْ خَسِرَ الَّذِينَ قَتَلُوا أَوْلَادَهُمْ سَفَهًا بِغَيْرِ عِلْمٍ وَحَرَّمُوا مَا رَزَقَهُمُ اللَّهُ افْتِرَاءً عَلَى اللَّهِ ۚ قَدْ ضَلُّوا وَمَا كَانُوا مُهْتَدِينَ۝

“নিশ্চয় তারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, যারা নিজ সন্তানদেরকে নির্বুদ্ধিতাবশতঃ কোন প্রমাণ ছাড়াই হত্যা করেছে এবং আল্লাহ তাদেরকে যেসব দিয়েছিলেন, সেগুলোকে আল্লাহর প্রতি ভ্রান্ত ধারণা পোষণ করে হারাম করে নিয়েছে। নিশ্চিতই তারা পথভ্রষ্ট হয়েছে এবং সুপথগামী হয়নি।” (৬:১৪০)

তৎকালীন আরব সমাজ পরকাল সম্পর্কে ছিল সম্পূর্ণ সন্দিহান। তারা পার্থিব জীবনের সাময়িক চাকচিক্যে মুগ্ধ হয়ে হিতাহিত জ্ঞানশূণ্য হয়ে পড়েছিল। বিভিন্ন ধরনের অপকর্মে লিপ্ত হয়ে তারা পরকালীন অনন্ত জীবনের কথা ভুলে যায়। তাদের ধারণা – তারা কখনও পুনরুত্থিত হবো না, মৃত্যুর পর কোন জবাবদিহি করতে হবে না, কোন বিচারের সম্মুখীন হতে হবে না এবং তাদের পার্থিব কর্ম–কান্ডের জন্য জাহান্নামের শাস্তি বা জান্নাতের পুরস্কার বলে কিছুই থাকবে না। তাদের কাছে পার্থিব জীবনই সব, আখিরাত বলে কিছু নেই।

পবিত্র কুরআনে আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা আখিরাত সম্পর্কে তাদের এসব ভ্রান্ত ধারণাকে খন্ডন করে বলেন:

اَفَحَسِبْتُمْ اَنَّمَا خَلَقْنكُمْ عَبَثًا وَّاَنَّكُمْ اِلَيْنَا لَا تُرْجَعُوْنَ۝

“তোমরা কি ধারণা করে নিয়েছ যে, আমি তোমাদেরকে অনর্থক সৃষ্টি করেছি এবং তোমরা আমার কাছে ফিরে আসবে না।” (২৩:১১৫)?”

وَقَالُوا أَإِذَا كُنَّا عِظَامًا وَرُفَاتًا أَإِنَّا لَمَبْعُوثُونَ خَلْقًا جَدِيدًا ۝ قُلْ كُونُوا حِجَارَةً أَوْ حَدِيدًا۝  أَوْ خَلْقًا مِّمَّا يَكْبُرُ فِي صُدُورِكُمْ ۚ فَسَيَقُولُونَ مَن يُعِيدُنَا ۖ قُلِ الَّذِي فَطَرَكُمْ أَوَّلَ مَرَّةٍ ۚ فَسَيُنْغِضُونَ إِلَيْكَ رُءُوسَهُمْ وَيَقُولُونَ مَتَىٰ هُوَ ۖ قُلْ عَسَىٰ أَن يَكُونَ قَرِيبًا۝

”তারা বলে: যখন আমরা অস্থিতে পরিণত ও চূর্ণ বিচূর্ণ হয়ে যাব, তখনও কি নতুন করে সৃজিত হয়ে উত্থিত হব? বলুন: তোমরা পাথর হয়ে যাও কিংবা লোহা। অথবা এমন কোন বস্তু, যা তোমাদের ধারণায় খুবই কঠিন; তথাপি তারা বলবেঃ আমাদের কে পুর্নবার কে সৃষ্টি করবে। বলুন: যিনি তোমাদেরকে প্রথমবার সৃজন করেছেন। অতঃপর তারা আপনার সামনে মাথা নাড়বে এবং বলবে: এটা কবে হবে? বলুন: হবে, সম্ভবতঃ শ্রীঘ্রই।” (১৭:৪৯ – ৫১)

الَّذِیْنَ یَصُدُّوْنَ عَنْ سَبِیْلِ اللّٰهِ وَ یَبْغُوْنَهَا عِوَجًا ؕ وَ هُمْ بِالْاٰخِرَۃِ هُمْ کٰفِرُوْنَ ۝ اُولٰٓئِكَ لَمْ یَکُوْنُوْا مُعْجِزِیْنَ فِی الْاَرْضِ وَ مَا كَانَ لَهُمْ مِّنْ دُوْنِ اللّٰهِ مِنْ اَوْلِیَآءَ ۘ یُضٰعَفُ لَهُمُ الْعَذَابُ ؕ مَا كَانُوْا یَسْتَطِیْعُوْنَ السَّمْعَ وَ مَا كَانُوْا یُبْصِرُوْنَ ۝ اُولٰٓئِكَ الَّذِیْنَ خَسِرُوْۤا اَنْفُسَهُمْ وَ ضَلَّ عَنْهُمْ مَّا كَانُوْا یَفْتَرُوْنَ ۝ لَا جَرَمَ اَنَّهُمْ فِی الْاٰخِرَۃِ هُمُ الْاَخْسَرُوْنَ ۝

“যারা আল্লাহর পথে বাধা দেয়, আর তাতে বক্রতা খুঁজে বেড়ায়, এরাই আখিরাতকে অস্বীকার করে। তারা পৃথিবীতেও আল্লাহকে অপারগ করতে পারবে না এবং আল্লাহ ব্যতীত তাদের কোন সাহায্যকারীও নেই, তাদের জন্য দ্বিগুণ শাস্তি রয়েছে; তারা (সত্য পথের কথা) শুনতে পারত না এবং (সুপথ) দেখতেও পেত না। এরা সে লোক, যারা নিজেরাই নিজেদেরকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে, আর এরা যা কিছু মিথ্যা মা’বুদ সাব্যস্ত করেছিল, (আখিরাতে) তা সবই তাদের থেকে হারিয়ে যাবে। আখিরাতে এরাই হবে সর্বাধিক ক্ষতিগ্রস্ত কোন সন্দেহ নেই।” (১১:১৯–২২)

اِنَّ الَّذِیْنَ اٰمَنُوْا وَ عَمِلُوا الصّٰلِحٰتِ وَ اَخْبَتُوْۤا اِلٰی رَبِّهِمْ ۙ اُولٰٓئِكَ اَصْحٰبُ الْجَنَّۃِ ۚ هُمْ فِیْهَا خٰلِدُوْنَ ۝ مَثَلُ الْفَرِیْقَیْنِ كَالْاَعْمٰی وَ الْاَصَمِّ وَ الْبَصِیْرِ وَ السَّمِیْعِ ؕ هَلْ یَسْتَوِیٰنِ مَثَلًا ؕ اَفَلَا تَذَكَرُوْنَ۝

“নিশ্চয়ই যারা ঈমান এনেছে ও সৎকাজ করেছে এবং স্বীয় পালনকর্তার সমীপে বিনতি প্রকাশ করেছে তারাই বেহেশতবাসী, সেখানেই তারা চিরকাল থাকবে। (জান্নাতী ও জাহান্নামী) উভয় পক্ষের দৃষ্টান্ত হচ্ছে যেমন (জাহান্নামীরা) অন্ধ ও বধির এবং (জান্নাতীরা) চক্ষুষ্মান ও শ্রবণশক্তিসম্পন্ন; উভয়ের অবস্থা কি এক সমান? তবুও তোমরা কি ভেবে দেখ না।” (১১:২৩ – ২৪)

 

আহলেকিতাবগণের বিভ্রান্তি

ইসলাম–পূর্ব যুগে যেসব সম্প্রদায় আসমানী কিতাব প্রাপ্ত হয়েছিল তারা ”আহলে কিতাব” নামে পরিচিত। যেমন, হযরত মূসা (আ)-এর সম্প্রদায়ের ওপর তৌরাত, হযরত ঈসা (আ)-এর সম্প্রদায়ের ওপর ইঞ্জিল এবং হযরত দাউদ (আ)-এর সম্প্রদায়ের উপর যবুর, ইত্যাদি। সেসব কিতাব যথাযথভাবে সংরক্ষিত না হওয়ায় এবং কিতাবধারীরা নিজেদের খেয়াল–খুশীমত সেগুলোকে বিকৃত করে ফেলায় নানা ধরনের মতভেদ ও বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়েছিল। তারা আল্লাহর সত্য দ্বীনকে ভুলে মনগড়া মতবাদের জন্ম দেয়। তৎকালীন আহলে কিতাবগণের মধ্যে ইহুদী ও খৃস্টানরাই ছিল প্রধান ধর্মীয় গোষ্ঠী। তাদের বিভ্রান্তির বিষয়গুলো নিম্নে আলোচিত হয়েছে।

 

ইহুদী সম্প্রদায়ের অনাচার

বনী ইসরাইল সম্প্রদায়ের একটি  গোষ্ঠীর নাম হলো ইহুদী যারা নিজেদেরেকে হযরত মূসা (আ)-এর অনুসারী বলে দাবী করে। তাদের উপর আল্লাহর অশেষ নিয়ামত থাকা সত্ত্বেও তাদের  অধিকাংশই ছিল অহংকারী, ওয়াদাভঙ্গকারী, দুষ্কর্মে সিদ্ধহস্ত, লোভী প্রকৃতির। তাদের অধিকাংশের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ছিল শঠতাপূর্ণ। এমন কি তারা তাদের কিতাব ‘তৌরাত’ কে মনগড়া কথা দ্বারা বিকৃত করেছিল।  তারা আল্লাহর আদেশ অমান্য করায় এবং তাঁর নিয়ামতসমূহকে অবজ্ঞা ও অস্বীকার করায় বারবার তাদের উপর নেমে আসে আল্লাহর লা’নত ও গযব। তাদের প্রত্যাশানুযায়ী সর্বশেষ নবী মুহাম্মদ (সা) বনী ইসরাইল জাতিগোষ্ঠীর না হওয়ায় তারা ছিল হতাশগ্রস্ত ও তাঁর প্রতি প্রচন্ড বিদ্বেষভাবাপন্ন। হযরত মুহাম্মদ (সা)সহ পূর্ববর্তী নবীগণের সাথেও তাদের আচরণ ছিল ধৃষ্টতাপূর্ণ। এমনকি অনেক নবীকে তারা হত্যাও করেছিল।

বিভিন্ন ধরনের অপরাধ ও বিভ্রান্তিতে পতিত ইহুদীরা মনে করত তারাই আল্লাহর একমাত্র আশীর্বাদপুষ্ট সম্প্রদায়। (৬২:৬)। তারা আরও মনে করত আমানতের খেয়ানত ও উম্মীদের অধিকার বিনষ্ট করাতে তাদের কোন পাপ নেই। আর তারা আল্লাহ সম্পর্কে জেনে শুনেই মিথ্যা বলে।” (৩:৭৫)। ‘ওযাইর আল্লাহর পুত্র’ – এ ধরনের বিশ্বাস পোষণ করে তারা শিরকে লিপ্ত হয়েছিল। (৯:৩০)।  তারা মিথ্যা বলার জন্যে তারা গুপ্তচর বৃত্তি করত। তারা তাদের গ্রন্থ তৌরাতের বাক্যসমূহ স্বস্থান থেকে পরিবর্তন করে ফেলত। (৫:৪১)। ঈসা (আ)– এর জন্মের ব্যাপারে তাঁর মাতা মরিয়াম (আ)– এর উপর তারা গুরুতর অপবাদ আরোপ করে এবং ঈসা (আ)– কে শূলীতে চড়িয়ে মৃত্যুদন্ড দেওয়ার কথাও তারা বলে থাকে। অথচ আল্লাহ্ সুবহানাহু তায়ালা তাঁকে জীবতাবস্থায় ঊর্ধাকাশে নিয়ে গেছেন। ইহুদীদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে কুরআনে বলা হয়েছে:

وَ تَرٰی كَثِیْرًا مِّنْهُمْ یُسَارِعُوْنَ فِی الْاِثْمِ وَ الْعُدْوَانِ وَ اَکْلِهِمُ السُّحْتَ ؕ لَبِئْسَ مَا كَانُوْا یَعْمَلُوْنَ ۝ لَوْ لَا یَنْهٰهُمُ الرَّبّٰنِیُّوْنَ وَ الْاَحْبَارُ عَنْ قَوْلِهِمُ الْاِثْمَ وَ اَکْلِهِمُ السُّحْتَ ؕ لَبِئْسَ مَا كَانُوْا یَصْنَعُوْنَ ۝

“আর আপনি তাদের অনেককে দেখবেন যে, দৌড়ে দৌড়ে পাপে, সীমালঙ্ঘনে এবং হারাম ভক্ষণে পতিত হয়। তারা অত্যন্ত মন্দ কাজ করছে। দরবেশ ও আলেমরা কেন তাদেরকে পাপ কথা বলতে এবং হারাম ভক্ষণ করতে নিষেধ করে না? তারা খুবই মন্দ কাজ করছে।” (৫:৬২ – ৬৩)

فَوَیْلٌ لِّلَّذِیْنَ یَکْتُبُوْنَ الْكِتٰبَ بِاَیْدِیْهِمْ ٭ ثُمَّ یَقُوْلُوْنَ هٰذَا مِنْ عِنْدِ اللّٰهِ لِیَشْتَرُوْا بِہٖ ثَمَنًا قَلِیْلًا ؕ فَوَیْلٌ لَّهُمْ مِّمَّا كَتَبَتْ اَیْدِیْهِمْ وَ وَیْلٌ لَّهُمْ مِّمَّا یَکْسِبُوْنَ ۝ وَ قَالُوْا لَنْ تَمَسَّنَا النَّارُ اِلَّاۤ اَیَّامًا مَّعْدُوْدَۃً ؕ قُلْ اَتَّخَذْتُمْ عِنْدَ اللّٰهِ عَہْدًا فَلَنْ یُّخْلِفَ اللّٰهُ عَہْدَہٗۤ اَمْ تَقُوْلُوْنَ عَلَی اللّٰهِ مَا لَا تَعْلَمُوْنَ۝

“অতএব তাদের জন্যে আফসোস! যারা নিজ হাতে গ্রন্থ লেখে এবং বলে, এটা আল্লাহর পক্ষ থেকে অবতীর্ণ -যাতে এর বিনিময়ে সামান্য অর্থ গ্রহণ করতে পারে। অতএব তাদের প্রতি আক্ষেপ, তাদের হাতের লেখার জন্য এবং তাদের প্রতি আক্ষেপ, তাদের উপার্জনের জন্যে। তারা বলে: আগুন আমাদিগকে কখনও স্পর্শ করবে না; কিন্তু গণাগুনতি কয়েকদিন। বলে দিন: তোমরা কি আল্লাহর কাছ থেকে কোন অঙ্গীকার পেয়েছ যে, আল্লাহ কখনও তার খেলাফ করবেন না -না তোমরা যা জান না, তা আল্লাহর সাথে জুড়ে দিচ্ছ।” (২:৭৯ – ৮০)

وَ اِنَّ مِنْهُمْ لَفَرِیْقًا یَّلْوٗنَ اَلْسِنَتَهُمْ بِالْكِتٰبِ لِتَحْسَبُوْهُ مِنَ الْكِتٰبِ وَ مَا هُوَ مِنَ الْكِتٰبِ ۚ وَ یَقُوْلُوْنَ هُوَ مِنْ عِنْدِ اللّٰهِ وَ مَا هُوَ مِنْ عِنْدِ اللّٰهِ ۚ وَ یَقُوْلُوْنَ عَلَی اللّٰهِ الْكَذِبَ وَ هُمْ یَعْلَمُوْنَ۝

“আর তাদের মধ্যে একদল রয়েছে, যারা বিকৃত উচ্চারণে মুখ বাঁকিয়ে কিতাব পাঠ করে, যাতে তোমরা মনে কর যে, তার কিতাব থেকেই পাঠ করছে। অথচ তারা যা আবৃত্তি করছে তা আদৌ কিতাব নয়। এবং তারা বলে যে, এসব কথা আল্লাহর তরফ থেকে আগত। অথচ এসব আল্লাহর তরফ থেকে প্রেরিত নয়। তারা বলে যে, এটি আল্লাহর কথা অথচ এসব আল্লাহর কথা নয়। আর তারা জেনে শুনে আল্লাহরই প্রতি মিথ্যারোপ করে।” (৩:৭৮)

وَ اِذْ اَخَذْنَا مِیْثَاقَکُمْ لَا تَسْفِکُوْنَ دِمَآءَکُمْ وَ لَا تُخْرِجُوْنَ اَنْفُسَکُمْ مِّنْ دِیَارِکُمْ ثُمَّ اَقْرَرْتُمْ وَ اَنْتُمْ تَشْهَدُوْنَ ۝ ثُمَّ اَنْتُمْ هٰۤـؤُلَآءِ تَقْتُلُوْنَ اَنْفُسَکُمْ وَ تُخْرِجُوْنَ فَرِیْقًا مِّنْکُمْ مِّنْ دِیَارِهِمْ ۫ تَظٰهَرُوْنَ عَلَیْهِمْ بِالْاِثْمِ وَ الْعُدْوَانِ ؕ وَ اِنْ یَّاْتُوْکُمْ اُسٰرٰی تُفٰدُوْهُمْ وَ هُوَ مُحَرَّمٌ عَلَیْکُمْ اِخْرَاجُهُمْ ؕ اَفَتُؤْمِنُوْنَ بِبَعْضِ الْكِتٰبِ وَ تَکْفُرُوْنَ بِبَعْضٍ ۚ فَمَا جَزَآءُ مَنْ یَّفْعَلُ ذٰلِكَ مِنْکُمْ اِلَّا خِزْیٌ فِی الْحَیٰوۃِ الدُّنْیَا ۚ وَ یَوْمَ الْقِیٰمَۃِ یُرَدُّوْنَ اِلٰۤی اَشَدِّ الْعَذَابِ ؕ وَ مَا اللّٰهُ بِغَافِلٍ عَمَّا تَعْمَلُوْنَ ۝ اُولٰٓئِكَ الَّذِیْنَ اشْتَرَوُا الْحَیٰوۃَ الدُّنْیَا بِالْاٰخِرَۃِ ۫ فَلَا یُخَفَّفُ عَنْهُمُ الْعَذَابُ وَ لَا هُمْ یُنْصَرُوْنَ ۝

“যখন আমি তোমাদের (ইহুদীদের) কাছ থেকে অঙ্গীকার নিলাম যে, তোমরা পরস্পর খুনাখুনি করবে না এবং নিজেদেরকে দেশ থেকে বহিষ্কার করবে না, তখন তোমরা তা স্বীকার করেছিলে এবং তোমরা তার সাক্ষ্য দিচ্ছিলে। অতঃপর তোমরাই পরস্পর খুনাখুনি করছ এবং তোমাদেরই একদলকে তাদের দেশ থেকে বহিষ্কার করছ। তাদের বিরুদ্ধে পাপ ও অন্যায়ের মাধ্যমে আক্রমণ করছ। আর যদি তারাই কারও বন্দী হয়ে তোমাদের কাছে আসে, তবে বিনিময় নিয়ে তাদের মুক্ত করছ। অথচ তাদের বহিষ্কার করাও তোমাদের জন্য অবৈধ। তবে কি তোমরা গ্রন্থের কিয়দংশ বিশ্বাস কর এবং কিয়দংশ অবিশ্বাস কর? যারা এরূপ করে পার্থিব জীবনে দুর্গতি ছাড়া তাদের আর কোনই পথ নেই। কিয়ামতের দিন তাদের কঠোরতম শাস্তির দিকে পৌঁছে দেয়া হবে। আল্লাহ তোমাদের কাজ–কর্ম সম্পর্কে বেখবর নন। এরাই পরকালের বিনিময়ে পার্থিব জীবন ক্রয় করেছে। অতএব এদের শাস্তি লঘু হবে না এবং এরা সাহায্যও পাবে না।” (২:৮৪ – ৮৬)

مَثَلُ الَّذِیْنَ حُمِّلُوا التَّوْرٰىۃَ ثُمَّ لَمْ یَحْمِلُوْهَا كَمَثَلِ الْحِمَارِ یَحْمِلُ اَسْفَارًا ؕ بِئْسَ مَثَلُ الْقَوْمِ الَّذِیْنَ كَذَّبُوْا بِاٰیٰتِ اللّٰهِ ؕ وَ اللّٰهُ لَا یَہْدِی الْقَوْمَ الظّٰلِمِیْنَ ۝

“যাদেরকে তওরাত দেয়া হয়েছিল, অতঃপর তারা তার অনুসরণ করেনি, তাদের দৃষ্টান্ত সেই গাধা, যে পুস্তক বহন করে, যারা আল্লাহর আয়াতসমূহকে মিথ্যা বলে, তাদের দৃষ্টান্ত কত নিকৃষ্ট। আল্লাহ যালেম সম্প্রদায়কে পথ প্রদর্শন করেন না।” (৬২:৫)

 

খৃস্টান সম্প্রদায়ের পথভ্রষ্টতা

খৃস্টান সম্প্রদায় এক ও অদ্বিতীয় আল্লাহর সমকক্ষ দাঁড় করায়। তারা ঈসা (আঃ)- কে আল্লাহর পুত্র ও সুপারিশকারী সাব্যস্ত করে। অথচ আল্লাহ্ রব্বুল আলামীন এক ও অনন্য। তাঁর সমকক্ষ বা সমতুল্য কেউ নেই। তিনি কারো জনক নন এবং তাঁকেও কেউ জন্ম দেয়নি। তাঁর জনক–জননী–স্ত্রী–পুত্র–কন্যা কিছুই নেই। এগুলো তাঁর জন্য শোভা পায়না। তিনি এসবের অনেক ঊর্ধে এবং পূত–পবিত্র । আল্লাহর অনুমতি ব্যতীত তাঁর নিকট কেহ তাদের কল্যাণ ও মুক্তির জন্য সুপারিশ করার অধিকার রাখে না। যারা এসব কল্পকথা তাঁর উপর আরোপ করে তারা নেহায়েত মিথ্যাবাদী এবং পথভ্রষ্ট। খৃস্টানরা একত্ববাদের বদলে ত্রিত্ববাদের মত শিরকি ধারণা পোষণ করত। তাদের এসব মিথ্যা সম্পর্কে মহান আল্লাহ্ বলেন:

اَلَا اِنَّهُمْ مِّنْ اِفْكِهِمْ لَيَقُوْلُوْنَ۝ وَلَدَ اللهُ وَاِنَّهُمْ لَكٰذِبُوْنَ۝

“দেখ, তারা মনগড়া উক্তি করে যে, আল্লাহ সন্তান জন্ম দিয়েছেন। নিশ্চয় তারা মিথ্যাবাদী।” (৩৭:১৫১ – ১৫২)

لَقَدْ كَفَرَ الَّذِينَ قَالُوا إِنَّ اللَّهَ هُوَ الْمَسِيحُ ابْنُ مَرْيَمَ ۖ وَقَالَ الْمَسِيحُ يَا بَنِي إِسْرَائِيلَ اعْبُدُوا اللَّهَ رَبِّي وَرَبَّكُمْ ۖ إِنَّهُ مَن يُشْرِكْ بِاللَّهِ فَقَدْ حَرَّمَ اللَّهُ عَلَيْهِ الْجَنَّةَ وَمَأْوَاهُ النَّارُ ۖ وَمَا لِلظَّالِمِينَ مِنْ أَنصَارٍ

”তারা কাফের, যারা বলে যে, মরিময়–তনয় মসীহ্ ই আল্লাহ; অথচ মসীহ বলেন, হে বনী-ইসরাঈল, তোমরা আল্লাহর এবাদত কর, যিনি আমার পালন কর্তা এবং তোমাদেরও পালনকর্তা। নিশ্চয় যে ব্যক্তি আল্লাহর সাথে অংশীদার স্থির করে, আল্লাহ তার জন্যে জান্নাত হারাম করে দেন। এবং তার বাসস্থান হয় জাহান্নাম। অত্যাচারীদের কোন সাহায্যকারী নেই।” (৫:৭২)

لَّقَدْ كَفَرَ الَّذِينَ قَالُوا إِنَّ اللَّهَ ثَالِثُ ثَلَاثَةٍ ۘ وَمَا مِنْ إِلَـٰهٍ إِلَّا إِلَـٰهٌ وَاحِدٌ ۚ وَإِن لَّمْ يَنتَهُوا عَمَّا يَقُولُونَ لَيَمَسَّنَّ الَّذِينَ كَفَرُوا مِنْهُمْ عَذَابٌ أَلِيمٌ

”নিশ্চয় তারা কাফের, যারা বলে: আল্লাহ তিনের এক; অথচ এক উপাস্য ছাড়া কোন উপাস্য নেই। যদি তারা স্বীয় উক্তি থেকে নিবৃত্ত না হয়, তবে তাদের মধ্যে যারা কুফরে অটল থাকবে, তাদের উপর যন্ত্রনাদায়ক শাস্তি পতিত হবে।” (৫:৭৩)

 

ইসলাম এবং সত্য-মিথ্যার দ্বন্দ

ইসলাম একটি চিরন্তন সত্যসুন্দরস্বাভাবিক মানব ধর্ম। আরবের পবিত্র মক্কায় ইসলামী সভ্যতার সূচনা এক সুপ্রাচীন ঘটনা। নবীরসুলগণের আগমণের ধারাবাহিকতায় প্রায় চার হাজার পূর্বে মুসলিম-উম্মাহর জনক নবী হযরত ইব্রাহীম (আঃ) এর আগমণের সাথে ইসলামী সভ্যতা ও সংস্কৃতির এক নিগূঢ় সম্পর্ক রয়েছে। ইসলামী দ্বীনের মূল ভিত্তি হলো “তৌহীদ” র্অথাৎ আল্লাহ্ রব্বুল আলামীনের একত্ববাদ। প্রথম মানব ও নবী হযরত আদম (আঃ) থেকে সর্বশেষ নবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) পর্যন্ত সকল নবী ও রসুলের প্রচারিত দ্বীন ছিল একটাই যার ভিত্তি ছিল কলেমা তৈয়্যিবা ’লাইলাহা ইল্লাল্লাহ্’ অর্থাৎ সৃষ্টিকুলের স্রষ্টা আল্লাহ্ রাব্বুল আলামীন ছাড়া অন্য কোন উপাস্য নেই – তিনি এক এবং অদ্বিতীয়, তাঁর কোন শরীক নেই। তিনি আমাদের পালনকর্তা ও জীবনমরণের মালিক, সমগ্র সৃষ্টির একক ও সার্বভৌম অধিপতি। সুতরাং সমস্ত প্রশংসা ও উপাসনার দাবীদার একমাত্র তিনিই – এটাই চিরন্তনস্বাভাবিকসত্য বাণী। আর এর নামই তৌহীদ বা একত্ববাদ। এই একত্ববাদের বাণীই প্রচার করেছেন আল্লাহর প্রেরিত সকল নবী ও রসুল। এই বাণীর সমর্থনেই তাঁদের কারো কারো ওপর নাযিল হয়েছে আল্লাহর কিতাবসমূহ। এসবের ওপর বিশ্বাস স্থাপন ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের ঈমানের অন্তর্ভূক্ত। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ্ বলেন:

قُولُوا آمَنَّا بِاللَّهِ وَمَا أُنزِلَ إِلَيْنَا وَمَا أُنزِلَ إِلَىٰ إِبْرَاهِيمَ وَإِسْمَاعِيلَ وَإِسْحَاقَ وَيَعْقُوبَ وَالْأَسْبَاطِ وَمَا أُوتِيَ مُوسَىٰ وَعِيسَىٰ وَمَا أُوتِيَ النَّبِيُّونَ مِن رَّبِّهِمْ لَا نُفَرِّقُ بَيْنَ أَحَدٍ مِّنْهُمْ وَنَحْنُ لَهُ مُسْلِمُونَ

”তোমরা বলো, আমরা আল্লাহতে বিশ্বাস করি, ও যা আমাদের ওপর, ইব্রাহীম, ইসমাঈল, ইয়াকুব ও তার বংশধরগণের ওপর অবতীর্ণ হয়েছে, আর যা তাদের প্রতিপালকের কাছ থেকে ঈসা, মূসা ও অন্যান্য নবীদের দেওয়া হয়েছে। আমরা তাদের মধ্যে কোন পার্থক্য করিনা, আর আমরা তাঁর (আল্লাহর) কাছে আত্মসমর্পণকারী (মুসলিম)।” (২:১৩৬)

সত্য ও মিথ্যার দ্বন্দ চিরন্তন। মিথ্যা শয়তানী প্ররোচনা থেকে উদ্ভূত যা মানুষকে সত্য পথ থেকে বিচ্যুত করে, বিভ্রান্তির সৃষ্টি করে ও পদস্খলন ঘটায়। মানব জাতির চরম শত্রু শয়তান ও তার অনুসারীরা প্রতি নিয়ত মিথ্যা ও প্রতারণার জাল বিস্তার করে মানুষের মধ্যে বিভ্রান্তি, অসততা, দ্বন্দ ও সংঘাত সৃষ্টির প্রচেষ্টা চালিয়েছে এবং সত্যকে মিথ্যার দ্বারা কলুষিত করার প্রয়াস পেয়েছে। তারা তাদের মিথ্যাচার ও দুষ্কর্ম দ্বারা মহান আল্লাহর সত্য ধর্ম ও বাণীকে বিকৃত করেছে এবং তাঁর নূরকে নির্বাপিত করতে চেয়েছে। কিন্তু আল্লাহ্ মানব জাতির হেদায়েতের জন্য তাঁর সত্য-পথ নির্দেশক নূরকে  চির সমুজ্জ্বল রাখতে চান। এ জন্য তিনি যুগে যুগে পাঠিয়েছেন নবী ও রসূল এবং নাযিল করেছেন আসমানী কিতাব যাতে মানুষ সত্য ও মিথ্যার পার্থক্য উপলব্ধী করতে পারে এবং  সত্যের উপর প্রতিষ্ঠিত থাকতে পারে। প্রত্যেক নবী ও রসূল নিজ নিজ জাতি ও গোত্রকে আল্লাহর বাণীর দ্বারা সত্য ও সুপথের সন্ধান দিয়েছেন। তাঁরা সত্যের আলোকে মিথ্যাচার ও বিভ্রান্তি থেকে মানুষকে মুক্ত রাখার প্রয়াস চালিয়েছেন। অবশেষে মিথ্যা পরাভূত হয়েছে এবং সত্যের জয় নিশ্চিত হয়েছে। আল্লাহ্ রব্বুল আলামীন বলেন:

وَقُل رَّبِّ اَدْخِلْنِىْ مُدْخَلَ صِدْقٍ وَاَخْرِجْنِىْ مُخْرَجَ صِدْقٍ وَّاجْعَلْ لِّىْ مِنْ لَّدُنْكَ سُلْطٰنًا نَّصِيْرًا۝ وَقُلْ جَآءَ الْحَقُّ وَزَهَقَ الْبٰطِلُ اِنَّ الْبٰطِلَ كَانَ زَهُوْقًا۝

“(হে নবী) বলুন: হে পালনকর্তা! আমাকে দাখিল করুন সত্যরূপে এবং আমাকে বের করুন সত্যরূপে এবং দান করুন আমাকে নিজের কাছ থেকে রাষ্ট্রীয় সাহায্য। বলুন: সত্য এসেছে এবং মিথ্যা বিলুপ্ত হয়েছে। নিশ্চয় মিথ্যা বিলুপ্ত হওয়ারই ছিল।” (১৭:৮০ – ৮১)

নবুওত ও রিসালতের ধারাবাহিকতার সমাপ্তি লগ্নে আখেরী নবী ও রসূল হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) আবির্ভূত হয়েছেন। সত্য ও মিথ্যার চিরন্তন দ্বন্দ নিরসনে তাঁর উপর নাযিল হয়েছে সর্বশেষ কিতাব পবিত্র কুরআন। আল্লাহ্পাক তাঁর এ পবিত্র কালামে সত্যকে পরিস্ফুট এবং মিথ্যাকে চিহ্নিত ও বর্জনীয় করেছেন যাতে তাঁর নবী ও রসূল মুহাম্মাদ (সাঃ) বিশ্বজগতের জন্যে সতর্ককারী হন। নিম্নোক্ত আয়াতসমূহে মহান আল্লাহর এ উদ্দেশ্যই ব্যক্ত হয়েছে:

تَبَارَكَ الَّذِىْ نَزَّلَ الْفُرْقَانَ عَلٰى عَبْدِه لِيَكُوْنَ لِلْعٰلَمِيْنَ نَذِيْرًا۝

“পরম কল্যাণময় তিনি যিনি তাঁর বান্দার প্রতি ফয়সালার (সত্য–মিথ্যার পার্থক্যকারী) গ্রন্থ অবর্তীণ করেছেন, যাতে তিনি (নবী মুহাম্মাদ সাঃ) বিশ্বজগতের জন্যে সতর্ককারী হন।” (২৫:১)

هُوَ الَّذِىۤ اَرْسَلَ رَسُوْلَه بِالْهُدٰى وَدِيْنِ الْحَقِّ لِيْظْهِرَه عَلَى الدِّيْنِ كُلِّه وَكَفٰى بِاللهِ شَهِيْدًا۝

“তিনিই তাঁর রসূলকে হেদায়েত ও সত্য ধর্মসহ প্রেরণ করেছেন, যাতে একে অন্য সমস্ত (বাতিল) ধর্মের উপর জয়যুক্ত করেন। সত্য প্রতিষ্ঠাতারূপে আল্লাহ যথেষ্ট।” (৪৮:২৮)

قُلْ اِنَّ رَبِّىْ يَقْذِفُ بِالْحَقِّ ط عَلّٰمُ الْغُيُوْبِ۝ قُلْ جَآءَ الْحَقُّ وَمَا يُبْدِئُ الْبٰطِلُ وَمَا يُعِيْدُ۝

“বলুন, আমার পালনকর্তা সত্য দ্বীন অবতরণ করেছেন। তিনি আলেমুল গায়ব। বলুন, সত্য আগমন করেছে এবং অসত্য না পারে নতুন কিছু সৃজন করতে এবং না পারে পূনঃ প্রত্যাবর্তিত হতে।” (৩৪:৪৮৪৯)

অধ্যায়সমূহ